প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কলিকাতার ইতিবৃত্ত বইতে পড়লাম, কলকাতার বহু প্রাচীন পরিবারে এখনও সতীর সিঁদুর পুজো করা হয়। তার অর্থ, আমার মামার বাড়ির পরিবার, বইয়ে বর্ণিত তেমনই একটি পরিবার। জেনে-ইস্তক আমার শরীরের শিরা উপশিরা কাঁপছে। চোখে ভাসছে সেই দৃশ্য – বইতে যেমন পড়েছি, সালঙ্কৃতা, মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা, আলুলায়িত কেশ, খালি পা, বধূকে পথ দিয়ে ধরে নিয়ে চলেছে নাপিতানীরা। সিদ্ধি জাতীয় কিছু খাইয়ে চেতনা কিছুটা বিস্রস্ত করে দেওয়া হয়েছে। পথে মাঝেমাঝেই লোকেরা এসে সতীর সিঁদুর নিয়ে যাচ্ছে। চিতার ওপরে মৃত স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে চিতায় বসেছেন বধূ, ডালপালা দিয়ে ঢাকা দেওয়া হল। অগ্নিসংযোগ করা হল, লোক ভেঙে পড়েছে, চারিদিকে ঢাক-ঢোল বাজছে, জয়ধ্বনি উঠেছে – লেলিহান আগুনের শিখায় জ্বলে যাচ্ছে বাংলার উজ্জ্বল ইতিহাস, চৈতন্যের ভক্তিবাদ, সন্ন্যাসীদের শিবজ্ঞানে জীবসেবা – কান মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। ছি ছি ছি! আর আমি ভাবতে পারছি না। ছয় প্রজন্ম আগে, কে মা তুমি প্রাণ দিয়েছ? তোমার মৃত্যু নয়, জীবন জানতে চাই আমি। তুমি কোন বাড়ির মেয়ে, কি তোমার নাম? কোনো সূত্র তো নেই। ... ...
আমরাও বাবার শুনে শুনে খুব জোরে জোরে চেঁচিয়ে আলক্ষ্মী বিদায় করে দিতুম। তারপর বাবা তালপাতার পাখা আর বেতের কুলো নামিয়ে আনত। এগুলো ঠাকুরের জায়গায় তোলা থাকত। তিনজন মিলে সেগুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে ছড়া কেটে বাতাস দিয়ে দিয়ে রাস্তায় গিয়ে অলক্ষ্মীকে তাড়িয়ে দিতুম। কুলোর বাতাস আর পাখার বাতাস দিতে আমাদের দু’ বোনের এত উৎসাহ আর তিড়িং বিড়িং লাফালাফি দেখে বাবা হা হা করে হাসত। বাবা খুব শান্ত, চুপচাপ মানুষ ছিল। কিন্তু ঐ লক্ষ্মীপুজোর দিন বাবা যেন আমাদের সমবয়সী ছেলেমানুষ হয়ে যেত। এখন বুঝি, ঐ সব রীতি বাবার ছোটবেলার স্মৃতিতে মিশে ছিল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাবা নিজের ছোটবেলায় ফিরে যেত। ... ...
বড়জ্যাঠাইমা খুব ভালো গুড়-আমের মোরব্বা করতে পারত আর সেজজ্যাঠাইমার মা দারুণ চিনি দিয়ে আমের মোরব্বা করতে পারতেন। মোরব্বার ক্ষেত্রে কাঁচা আমের নির্বাচন যদি ঠিক না হয়, তবে ব্যর্থ হতে হবে। আমের আঁটি হয়নি – এতটা কচি আম যেমন চলবে না, তেমন আঁটি শক্ত হয়ে গেছে – এমন আমও নিলে হবে না। দুইয়ের মাঝামাঝি দরকার, মানে নরম আঁটি যুক্ত আম চাই। এবারে আঁটির কষি বাদ দিয়ে আমগুলোকে লম্বায় চারফালি বা ছয়ফালি করতে হবে। কয়ফালি কাটা হবে, সেটা আমের আকারের ওপর নির্ভর করবে। এবারে বড়জ্যাঠাইমা আমগুলো নুনে জরিয়ে রোদে শুকিয়ে নিত। এবারে কড়াতে পরিমাণমত ঘি দিয়ে ঐ শুকনো আমগুলো ভাজত। ভাজা হয়ে গেলে গাঢ় চিনি বা গুড়ের রসে আমগুলো ফুটবে। কারোর ইচ্ছে হলে ঐ পাকে আদার রস মেশানো যায়। মোরব্বা তৈরি হলে আঁচ থেকে নামিয়ে এলাচ গুঁড়ো মেশাতে হবে। ... ...
মা রকমারি সরবৎ বানাতে পারত। দেশি লেমোনেড – লেবু চিনির সরবৎ তো ছিলই, এছাড়া কাঁচা আমপোড়া সরবৎ, পাকা আমের ভাজা মশলা দেওয়া সরবৎ, রোজ সিরাপ মিশিয়ে তরমুজের সরবৎ, মিষ্টি দইয়ের ঘোল, টক দই আর পুদিনার সরবৎ - এইসব। হাতিবাগানে সিনেমা দেখতে গেলে, বাবা একটা দোকানে গুঁড়ো বরফ দেওয়া আম আর দইয়ের সরবৎ খাওয়াত। আর ধর্মতলায় গেলে প্যারামাউন্টের সরবতের ভাণ্ডার তো ছিলই। সর্দি-কাশি হলে মা মিছরি, গোলমরিচ, তেজপাতা আর আদা ফুটিয়ে, গরম সরবৎ বানিয়ে, কাপে করে নিয়ে এসে বলত, খেয়ে নে। গলায় খুব আরাম হত। ... ...
আমাদের গ্রামের বাড়ি বসিরহাটের আড়বালিয়ায়। সেখানে একরকম ছোটো দানা লালচে কমলা রঙের পাতলা পাতলা ভাঙা মুসুর ডাল পাওয়া যেত। দোকানে বলত, মারুতি-ভাঙা ডাল। ঐ ডালে মা ফোড়ন না দিয়ে, শুধু ডালসেদ্ধ করত। কাঁচা ডালে জল দিয়ে, তাতে কাঁচা সর্ষের তেল, নুন, মিষ্টি, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বসিয়ে দিত। সে ডালে কি যে ছিল! ঐ সেদ্ধ ডাল যেন অমৃত লাগত খেতে। আমার বিয়ের পরেও কিছু বছর আড়বেলেতে ঐ ডাল পেয়েছি। আমার কর্তাও ঐ ডালসেদ্ধর প্রেমে মজেছিলেন। কিন্তু এখন আর পাই না। আর মাঝে মাঝে মা রাতে সাদা কাপড়ে ডাল বেঁধে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে ফেলে দিত। তারপর সেই টাইট ডালের বল কাঁচা সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে মাখা হত। বেশ খেতে লাগত। ... ...
একটা পিঁড়িতে উবু হয়ে বসে মা রান্না করত। রান্না হয়ে গেলে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে উনুন নিকোনো হত আর উনুন থেকে একটা সুন্দর সোঁদা গন্ধ উঠত, ঠিক বৃষ্টি পড়লে যেমন হয়, তেমন। আমার বোন ঐ গন্ধের লোভে উনুন চাটত। অনেক বারণ, বকাঝকা করলেও তাকে থামানো যেত না। উনুনে সোঁদা গন্ধ উঠলেই, পিলপিল করে দৌড়ে ছোট্ট জিভ বার করে উনুন চেটে দিত। ভাঁড়ে রসগোল্লা বা দই এলেও সেই সব ভাঁড় কামড়াত। এত দুরন্ত, সামলানো যেত না – বাবা ওর নাম দিয়েছিল বিলবিলে বাহাদুর। সকলে যখন জিজ্ঞেস করত, বাবা কি নাম দিয়েছে? – গরবিনী উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করত – বিব্বিলে ভা-দুর। আমি বইপত্র নিয়ে থাকতাম, রান্নাঘরের দিকে অত নজর ছিল না, কিন্তু বোনের ছিল। দুপুরবেলা যখন কেউ দেখত না, ও-ই গিয়ে শিক দিয়ে, বড়দের মত উনুন খোঁচাত। ... ...
হায় সেই কাছাখোলা বাঙালি- শেষ পাতে সাবানের সুপে কাত/ বিপ্লব ও আইসক্রিম হাতে হাত - ভুসুকু খাইলি ফিস ওরলি। কিচাইনে এক ঋতু অবসান - ফিরিঙ্গি নালে ঝোলে চণ্ডাল / ডিডি ভনে বেমালুম ইতিহাস/ বিরতিতে কাঁটা বেছে বেছে খান ... ...
সোনা রোদ্দুরে আবিল দুপুর পশমিনা শালে ঝোল কলঙ্ক, কিন্তু কেমন স্মৃতিভারাতুর, ভাঁড়ের ছ্যাঁদায় কাছা কোঁচা ময়। বে'বাড়ির ভোজে আঁচাবো কোথায়, অম্বল সুধা, ধূমপানে মন? যত্নে প্রত্ন খুঁড়ে দেখাবেন সঙ্গে আছেন ডিডি মহাশয়। ... ...
আপ রুচি খানা? কে বলে মশাই? সব্বার আগে দরকার ভাই এটিকেট জানা। বিলেতে খানা খেতে খেতে কদাচ যেন না ওঠে বিশ্রী ঢেকুর। নাইজেরিয়ায় আবার খাবার নিমন্ত্রনে ব্যাঘ্র গর্জনে ঢেকুরই দস্তুর। বিলেতে চা বা স্যুপ পানে, সুড়ুৎ শব্দটুকু হওয়া মানে মহাসব্বোনাস। ওদিকে জাপানে, যাবতীয় পানে শোনা যাবে এমন হুসহাস, যেন শত অ্যানাকোন্ডায় ফেলছে নিশ্বাস। ইত্যাকার এটিকেট জেনে পাও গুড ম্যানার্স সার্টিফিকেট। দুনিয়ার কোনও দেশে নিমন্ত্রনে খেতে বসে পড়বে না ঢিঢি। শিক্ষা দিতে ইত্যাকার আচার, যথারীতি হেঁশেলে হুঁশিয়ার রয়েছেন ডিডি ... ...
খাই খাই কর কেন? এসো বোসো আহারে। দুই শো বছর পরে খাবে যা-যা বাহারে, এসো ভায়া ট্রাই করো, আজই খাও তাহারে। আরশোলা-চচ্চড়ি, গুবরের কালিয়া, মশক-পুডিং খেও সেলফি-টি তুলিয়া। আরও দু-শতক পরে, জেনে রেখো নির্ভুল, খানা মানে খাবে শুধু ক্ষুধাহরা ক্যাপসুল! কী হবে রেসিপি তার, ভারী শখ জানবার? এখানে লিখলে যদি ‘গুল’ বলে পড়ে ঢিঢি? দক্ষিণে পাড়ি দাও, কানে কানে জেনে নাও, হেঁশেলেতে যথারীতি হুঁশিয়ার আছেন ডিডি ... ...
খাওয়ার আগে গালি খাওয়াবে, আছে এমনও রেস্তোরাঁ এ ভবে। কিংবা খাবেন পলিটিকাল খানা? সে হদিশও দিব্যি জানা। রান্না ছাড়ুন, এ কিস্তিতে ঘুরেই আসুন, তেমন নানা খানাঘরে, আর দেরি না করে। হলেন নাকি রেডি? পথ দেখাতে তৈরি আছেন দেখুন স্বয়ং ডিডি ... ...
খানা-সংস্কৃতি ভাই! ইদানীং ফ্যাশন ওইটাই! শুধু খেলে হাঁসফাঁস করে হবেনি কো, জানতে হবে ইতিহাস, ঝাড়তে হবে দেরিদা-ফুকো! কিন্তু যদি উলতো গাই? এ বাজারে এট্টু অপোসংস্কিতি ফলাই! রাখুন ও সব লবচবানি, রাঁধুন মাটন কেওরামি! কে বলে তাতে পড়বে ঢিঢি? রেসিপি দাতা স্বয়ং ডিডি ... ...
অনেক হয়েছে ভায়া ন্যাকা-নস্টালজিয়া। ‘মায়ের রান্না’, মনে পড়তেই সে কী কান্না। আহা পিসির হাতের সেই চ্যবনপ্রাশ-ভাতে! তার চেয়ে বরং ছেড়ে সব ঢং রেঁধেই ফেলুন তুখোড় ‘পটাটাস মাতাদোর’। কিংবা ছেড়ে আজেবাজে কথা, রাঁধুন ‘চিকেন বনলতা’। ভয় নেই, বলেছি তো সেই কবেই, পড়বে না মোটে ঢিঢি—মিছে ঘাবড়াচ্ছেন, রেসিপি বাতলাচ্ছেন স্বয়ং ডিডি ... ...
শরৎ চাটুজ্জের শ্রীকান্ত রেঙ্গুনের রাস্তায়, খুঁজছেন, বাঙালি কিধার হ্যায়? দেখে শেষে ল্যাজ খান, বাঙালিকে চিনে যান। বাঙালির নয়, ছি-ছি, মৎসের ল্যাজা সেটি, হাতে থলি বাজারের, তাতেই প্রমাণ ঢের—বাঙালিকে দুনিয়ায়, মাছ দিয়ে চেনা যায়। এইবার যদি চাও, চিংড়ি-পুলাও তাও রেঁধে ফেল, ভয় কী?, এই নাও রেসিপি, পড়বে না আর ঢিঢি, হেঁশেলে যে হুঁশিয়ার স্বয়ং হাজির ডিডি ... ...
পটোলেতে ফুলকপি ব্যাকরণ মানি না। নেই যে দাঁতের তেজ হেরিটেজ জানি না—‘কচি পাঁটা’ হাড়সার, কেনই বা খাব আর, রেওয়াজি-চর্বিওলা খোজা পাঁঠা থাকাতেও?! বাঙালির আলু চাই বিরিয়ানি পাকাতেও। নস্টালজিয়া থাক, নবীনেরা হরগিজ, আলুপোস্তয় দেবে পারমেসিয়ান চিজ! ডিমান্ড ও সাপ্লাই হেঁশেলেতে দিল ধুম, বাঙালি বছরভর খেতে পেল মাশরুম! প্রাণ চায়? রেঁধে যান পড়বে না মোটে ঢিঢি, হেঁশেলে যে হুঁশিয়ার হাজির আছেন ডিডি। ... ...
তবে আর কী। হাতে নিন হাতা-খুন্তি। আর নিজেই করে ফেলুন খানা তৈয়ার। দুই কিসিমের রেসিপি এবার। যারে কয় হাঁসজারু, থুড়ি ফিউশন খাবার—নাম? ফুলকপির হাইকু! আহা খানা নয়, যেন পঙ্ক্তি কবিতার! সঙ্গে তার খানা গুরুবাদী, থুড়ি খানা অথেন্টিক, আগমার্কা খাঁটি— বাদশাহি বিন্স। চেবাতেই মেজাজখানা ঠিক যেন রাজা-রাজড়ার। ভয় নেই, মশলার ভুলে পড়বে না ঢি ঢি! বলে দিতে রান্নার নানা প্যাঁচপয়জার হাজির যে ডিডি। ... ...